‘অনসম্বল’ নাট্যদলের নতুন প্রযোজনা ‘ভীতি’, সোহাগ সেনের নির্দেশনায় অসামান্য উপস্থাপনা
21 November 2024
Ensemble, Kolkata

সোহাগ সেন। চলচ্চিত্র তৈরির ওয়ার্কশপে যেমন তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম, তেমনই নাট্য নির্দেশক রূপেও তিনি আইকনিক পার্সোনালিটি। একের পর এক মঞ্চসফল নাটক দিয়ে তিনি নিজের জাত চিনিয়েছেন।

‘অনসম্বল’ নাট্যদলের নতুন প্রযোজনা ‘ভীতি’, সোহাগ সেনের নির্দেশনায় অসামান্য উপস্থাপনা 

মঞ্চস্থ হল সোহাগ সেনের নাটক ‘ভীতি’।  

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় 

সোহাগ সেন। চলচ্চিত্র তৈরির ওয়ার্কশপে যেমন তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম, তেমনই নাট্য নির্দেশক রূপেও তিনি আইকনিক পার্সোনালিটি। একের পর এক মঞ্চসফল নাটক দিয়ে তিনি নিজের জাত চিনিয়েছেন। এবার মঞ্চস্থ হল সোহাগ সেনের নাটক ‘ভীতি’।  ‘অনসম্বল’ নাট্যদলের নতুন প্রযোজনা ‘ভীতি’ সোহাগ সেনের নির্দেশনায় এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটাল মঞ্চে। 

সমাজে সংসারে আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে ভয়। নানা রকমের নানা ধরনের ভয়, যা আমরা সবসময় অতিক্রম করতেও পারি না। রাস্তাঘাট,স্কুল কলেজ অফিস, এমনকী বাড়িতে থেকেও নিরাপত্তাটুকু নেই আমাদের। সোহাগের গল্প বলায় আধুনিক সময়ের প্রতিফলন উঠে এসেছে মঞ্চে। 

সম্প্রতি  অ্যাকাডেমিতে মঞ্চস্থ হল সোহাগ সেনের নাটক ‘ভীতি’। মঞ্চের গল্প যেন মিলে যায় বাস্তবের সঙ্গে। এই যে এত প্রতিবাদ,ধর্না,মিটিং,মিছিল তাতে উচ্চবিত্ত সমাজের আদৌ কী কিছু এসে যায়? তাঁরা কী নিজেদের আর্থিক নিরাপত্তা আর উচ্চবিত্ত স্টেটাস ধরে রাখতে গা বাঁচায় প্রতিবাদের স্বর থেকে? কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল এই প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করায় ‘ভীতি’। 

জার্মান নাট্যকার বার্টল্ট ব্রেখট-এর ‘ফিয়ার অ্যান্ড মিজারি অফ দ্য থার্ড রাইখ’ (১৯৩৮) এর নির্যাস নিয়ে ‘ভীতি’ নাটকটি সৃজন করেছেন সোহাগ।  নাট্যকার একেবারে বাঙালি জীবনের মোড়কে নাট্যরূপ দিয়েছেন , কিন্তু নাটকের চলন আন্তর্জাতিক। এটাই সোহাগের সিগনেচার টাচ্। 

দুটি উচ্চবিত্ত পরিবারকে নিয়ে গল্প। দুটি পরিবার দিনান্তে প্রায়ই একসাথে বসে নিশিযাপনে। মদ্যপান আর নৈশভোজের মধ্যে দিয়ে তাঁরা সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে গল্পে-গানে-আড্ডায়। কিন্তু শান্তির সময়ে বারবার এসে পড়ে ভয়ের ছায়া। প্রথম পরিবারের দম্পতি রণ আর শর্মিষ্ঠা , দুজনেই আর্থিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত। রণ অর্থনীতির অধ্যাপক।

কিন্তু বাবা-মায়ের ব্যস্ততায় তাদের ছেলে অন্তু একেবারেই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। গাঁজা মদ থেকে দুর্বৃত্ত দলের দোসর সে। তার ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন তার বাবা-মা। দ্বিতীয় পরিবারের দুজন সদস্য  দিব্য আর আরফিন। কিন্তু এই সামাজিক প্রতিবাদ, ধর্না দূরত্ব তৈরি  করে দুজনের মধ্যে। দিব্য উচ্চপদস্থ সরকারি  আমলা। মাত্র তিন বছরের কাজের অভিজ্ঞতায় সে সরকারের সঙ্গে  বিদেশ ভ্রমণের অফার পেয়েছে।

এদিকে দিব্যর স্ত্রী আরফিন সমাজসেবামূলক কাজ করে থাকে। যার মাথা রাণুদি। এই মহিলারা প্রতিবাদী ধর্নামঞ্চের পাশে দাঁড়ায়। আরফিন প্রতিবাদের উজ্জ্বল মুখ হয়ে উঠতে থাকে। আর আরফিনের এই কাজের প্রভাব বাধা হয়ে দাঁড়ায় দিব্যর সরকারি প্রমোশনে। কিন্তু আরফিন ছেড়ে দিতে পারেনা তার নৈতিক কর্তব্য। তাহলে কোনদিকে যাবে পরিবারটি? নাকি দুটি প্রতিবেশী পরিবার পরস্পর পরস্পরের সমস্যা ভাগ করে নেবে শুভ চিন্তায়? 

‘ভীতি’ নাটকে সোহাগ সেনের পরিচালনা এই সময়ে আমাদের সামনে আয়না ধরে। যেন আমাদের অনেকের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই রণ,শর্মিষ্ঠা,দিব্য,আরফিনের মধ্যে দিয়ে। সবথেকে বড় কথা এই নাটকে সে অর্থে কো স্টার আর্টিস্ট অভিনয় করেননি। কিন্তু সাবলীল অভিনয় আর গল্পের ধারালো বুনটে অ্যাকাডেমি হয়ে যায় কানায় কানায় পূর্ণ। 

অভিনয়ে সবথেকে সেরা দিব্যর চরিত্রে কৌশিক বোস। নিজের কেরিয়ারের উন্নতির জন্য তাঁর উদ্বেগ, অস্থিরতা থেকে প্রাঞ্জল মুহূর্তের অভিনয় ভীষণ সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। কৌশিকের তিন দশকের পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতা তার অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট। আরফিন চরিত্রে সোমা মুখোপাধ্যায় যোগ্যসঙ্গত করেছেন। রণের চরিত্রে চমকে দিলেন সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সুজয়কে এতদিন ভিলেন চরিত্রে বা কোমল চরিত্রে সিরিয়ালে টেলিভিশনে দেখা যেত।

‘ভীতি’ কিন্তু এক অন্য সুজয়কে আমাদের সামনে আনল। সোহাগ সেন নিজের মতো করে গড়েছেন সুজয়প্রসাদকে। এই রণ চরিত্রটি যেন সুজয়কে মুক্তি দিল। এক উঠতি যুবকের বাবার চরিত্রে সুজয়, কিন্তু তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বে আর আভিজাত্যে যেন কমল মিত্র ঘরানার ছাপ পাই। এই ধরনের চরিত্রে  যে সুজয়প্রসাদ পারেন তা তিনি প্রমাণ করলেন। বিশেষত স্ত্রী শর্মিষ্ঠার সঙ্গে ঝগড়া দৃশ্যে সুজয়ের কন্ঠাভিনয় গায়ে কাঁটা দেয়। আবার যখন মঞ্চেই খালি গলায় দেব আনন্দের ছবির গান গেয়ে ওঠেন সুজয় তখন তা যেন এক সন্ধ্যারাগের আবেশে ডুবিয়ে দেয়।

এখানে কোনও  লাউড সাজ নয়, একেবারে শ্বেতশুভ্র পোশাকে সুজয়প্রসাদ ব্যক্তিত্বময়। ওঁর স্ত্রী শর্মিষ্ঠার চরিত্রে সুতপা ঘোষ যদি না থাকতেন সুজয়ের অভিনয় এতটা হয়তো পূর্ণতা পেত না। কারণ দুজনের কেমিস্ট্রি। সুতপা ঘোষ মঞ্চ মাতিয়ে দিলেন দাপুটে অভিনয়ে। ছেলে অন্তুর চরিত্রে বিশাল চক্রবর্তী বেশ ভাল । 

নিরাভরণ রুচিশীল সেট, কৌশিক বোসের আবহর দুর্দান্ত ব্যবহার ও বাবুল সরকারের আলোকসম্পাত নাটকটিকে আরও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। তবে উচ্চবিত্ত দেখানো মানেই কি  অবিরাম  মদ্যপান? 

এখনকার অধিকাংশ বাংলা নাটক রাজনীতি থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। ‘ভীতি’ কিন্তু একদম এই সময়ের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এই নাটক আমাদের ভাবায়, আমাদের ভাসায়। কোথাও গিয়ে ভয়কে জয় করতে শেখায় ‘ভীতি’।

Source: Click Here to view

Important Notifications