Dhawsh- ভয়কে জয় করার গল্প বলে সোহাগ সেন ও কৌশিক বসুর নতুন নাটক ‘ধ্বস’
24 November 2024
Ensemble, Kolkata

নির্মল ধর: সাধারণ মানুষকে সর্বদা ভয়ের অন্ধকারে ভুলিয়ে রাখতে পারলে শাসক সম্প্রদায় খুশিতে থাকে। ভয় মানেই আতংক। ভয় যত গভীর, আতঙ্ক ততই ভয়াবহ। রাজনীতির ব্যবসায়ী এবং শাসকদল সারা পৃথিবী জুড়ে সেটাই চায়। দেশ জুড়ে আতঙ্ক ও ভীতির পরিমণ্ডল তৈরি করে রাখতে পারলেই আর প্রতিবাদ হবে না, প্রতিরোধ ঘটবে না, বিপ্লব দূরের কথা! জনগণকে সারাক্ষণ চাপে ও চেপে রাখা যাবে। তাহলেই তো শাসনের এবং শাসকের উদ্দেশ্য সফল। সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে মানতে বাধ্য মৃত্যুর ভয়ে ভীত মানুষ। তুরস্কের নাট্যকার তুন্সের চুসেনগ্লও (Tuncer Cücenoğlu) সম্ভবত আফগানিস্তানের সামাজিক অবস্থার কথা মনে রেখেই ‘The Avalanche’ নামের নাটকটি লিখেছিলেন। সেই নাটক এবার ‘ধ্বস’ নামে (Dhawsh Drama) বাংলা মঞ্চে উঠে এল সোহাগ সেন ও কৌশিক বসুর অনুবাদে।

Dhawsh Drama 1

বুদ্ধিদীপ্তভাবেই নাটকটির অনুবাদ করেছেন সোহাগ সেন ও কৌশিক বসু। কোনও চরিত্রের বাংলা নাম দেননি। দাদু, দিদিমা, বাবা, মা, ছেলে, নাতি বা নাতবউ সকালেই উপস্থিত নামহীন হয়ে, সম্পর্কের সূত্রে। ফলে, নাটকটি স্থান ও কাল ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে।

মাত্র একটি ঘরে (বসার জায়গা, রান্নার স্পেস, আর শোবার ঘর) এটুকু জায়গা নিয়েই নাটকের বিস্তার। ঘরের বাইরে বরফ পড়ার আওয়াজ পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। গ্রামের পাশেই পাহাড়। সেখানে জমে আছে বিশাল বরফের চাঁই। দেশের শাসক কাউন্সিলের কড়া নির্দেশ কোথাও টুঁ শব্দটিও হলে বরফের ধ্বস নেমে এসে পুরো গ্রাম ভাসিয়ে দেবে। সকলের মৃত্যু হবে।
সুতরাং বছরের মাত্র তিনটি মাস স্বাভাবিক আচরণ। বাকি ন’মাস কোনও চিৎকার বা শব্দ নয়। এমনকী শিশুর কান্নাও নয়। সবাই থাকে অতি সন্তর্পণে। শব্দহীন গ্রামের জীবন। ঘরের ভিতরেও। এই নিয়ম রক্ষার জন্য শাসক নিযুক্ত রেখেছে হুমদো পাহারাদার। রয়েছে কাউন্সিলের প্রধান, তার কিছু সাগরেদ।

নাতবউ সন্তানসম্ভবা। প্রসব সময় প্রায় উপস্থিত। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মেয়েটি। কিন্তু চিৎকার তো দূরের কথা শব্দ করার অধিকার নেই। অতীতে এমনই এক সন্তানসম্ভবা তরুণীকে বাচ্চা-সহ জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়েছিল। আবারও কি তেমন কিছু হবে? এই আশঙ্কার পুরো পরিবার শঙ্কিত, ত্রস্ত, ভীত, আতঙ্কিত। বৃদ্ধ দাদু পুরানো দিনের কথা শোনায় আর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। ছেলে প্রতিবাদ করতে গেলে মা-বাবা বাধা দেয় ‘ধ্বস’ নামার ভয়ে।

তরুণী বধূ অসময়ে সন্তানসম্ভবা জেনে বাড়িতে হাজির হয় কাউন্সিল ও তাঁর সাগরেদরা। জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে বধূকে এটাই সিদ্ধান্ত। কিন্তু হয় কি? তরুণীর স্বামী বাড়ির ছোট ছেলে বন্দুক উঁচিয়ে প্রতিবাদ জানালে কাউন্সিলর ও তার সাগরেদরা ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ রুখতেই এতদিন মিথ্যে ও অলীক ভয়ের বাতাবরণ জিইয়ে রাখা হয়েছিল নিজেদের শাসন কায়েম রাখতে।

Dhawsh Drama 2

ভয় জয় করতে পারলেই জীবন পালটানো যায়। যায় সমাজ বদলানো। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সামনে শাসক সম্প্রদায় তখন কেঁচোর মতো গুটিয়ে যেতে বাধ্য। তাঁদের আসল ‘ভয়’ মানুষকেই। তাই মানুষকেই ভয় দেখিয়ে চুপ রাখার এই কূট কৌশল নেয় তারা।
তুন্সেরের এই নাটক প্রতীকের আড়াল দিয়ে সাম্প্রতিক নয়, চিরকালীন এক বাস্তবের সত্যটাকে তুলে এনেছে। রাজনীতি নিয়ে এতটুকু কথা না বলেও পুরো নাটকটিই রাজনীতির পোশাক গায়ে চড়িয়েছে নাট্যকারের সুপরিকল্পনায়। নির্দেশক সোহাগ সেন একেবারেই সহজ-সরল ভঙ্গিতে নাটকটির মূল বক্তব্য পরিষ্কারভাবে উপহার দিয়েছেন দর্শকদের।

পরিচ্ছন্ন সেট, আবহর সংক্ষিপ্ত ও সুষম ব্যবহার, আলোকসজ্জা নাটকটিকে আরও হৃদয়গ্রাহী করে। এবং অবশ্যই প্রায় প্রত্যেক অভিনেতার মিলিত প্রয়াস নাটকটিকে আরও বেশি গ্রহনীয় করে তোলে। দাদু ও দিদিমার চরিত্রে অসিত বসু ও সোহাগ সেন নিজে খুব নিচু লয়ে অভিনয় করেও কাঙ্ক্ষিত প্রতিবাদী এফেক্ট এনেছেন। মায়ের ভূমিকায় সুতপা ঘোষ খুবই জীবন্ত, খিটখিটে মেজাজ এবং স্নেহশীল শাশুড়ি দু’দিকই ভালভাবে ফুটিয়েছেন। নাতবউ ও নাতি হয়েছেন মধুরীতু ও সুনয়ন। তাঁদের অভিনয়ও পরিস্থিতি মাফিক স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ। এখনকার অধিকাংশ বাংলা নাটক রাজনীতি থেকে পালিয়ে বাঁচে। ‘ধ্বস’ কিন্তু মুখোমুখি হল। জানিয়ে দিল ভয়কে জয় করতে না পারলে জীবনে পরিবর্তন আসে না। পরিবর্তন করা যায় না সমাজেরও।

Important Notifications